অনেকদিন পর্যন্ত তো বটেই, এখনও ধারণা করা হয় মোটরগাড়ি শিল্প বা অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি শুধু ছেলেদের জন্যই। কিন্তু পাঠক, জেনে অবাক হবেন, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে মেয়েদের অবদান কম নয়। গাড়িতে আমরা বর্তমানে যেসকল আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে পাই, তার অনেকগুলোর উদ্ভাবনেই রয়েছে মেয়েদের অবদান।
বিশ্ব নারী দিবসে মোটরগাড়ি শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা কয়েকজন নারীর কথা তুলে ধরা হয়েছে।
শুরু করা যাক বার্থা বেঞ্জকে দিয়ে। জার্মান নারী বার্থা বেঞ্জ ছিলেন মোটরগাড়ির উদ্ভাবক ও বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মার্সিডিস বেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল বেঞ্জের স্ত্রী। ১৮৮৬ সালে কার্ল বেঞ্জ যখন ঘোড়াবিহীন পেট্রোলচালিত গাড়ি উদ্ভাবন করেন, তখন বার্থ বেঞ্জ গাড়িটি প্রায় ৬৬ মাইল চালান। বার্থা বেঞ্জকেই বিশ্বের প্রথম চালক বা ড্রাইভার বলা হয়। তিনি ৬৬ মাইল গাড়ি চালিয়ে ইতিহাস গড়েন এবং তার এই চালনার ফলে কার্ল বেঞ্জের উদ্ভাবন মানুষের নজরে আসে।
বার্থা বেঞ্জকে বিশ্বের প্রথম চালক বা ড্রাইভার বলা হয়
এরপর ধরুন বর্ষণমুখর একটি দিনের কথা। আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন, ধরা যাক গাড়িতে হালকা ভলিউমে গানও বাজছে, এমন সময়ে এলো বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে গাড়ির সামনের কাচ একদম ভিজে গেলও, কিছু দেখাও যাচ্ছেনা। এমন সময়ে আপনি কি করেন? নিশ্চয় ওয়াইপার চালু করে দেন। আমরা যাই ব্যবহার করি তার কিন্তু দুটো ভার্সন থাকে, একটি অটোমেটিক আরেকটি ম্যানুয়াল। মজার ব্যাপার হলো আমরা বৃষ্টির সময়ে যে ওয়াইপার ব্যবহার করি, তার অটোমেটিক এবং ম্যানুয়াল দুটোরই উদ্ভাবক কিন্তু নারী। ১৯০৩ সালে মেরী এন্ডারসন নামের একজন নারী উদ্ভাবন করেন ম্যানুয়াল ওয়াইপার এবং সেই ওয়াইপারকে ভিত্তি করে তার ১৪ বছর পর ১৯১৭ সালে শার্লট ব্রিজউড উদ্ভাবন করেন অটোমেটিক ওয়াইপার। অটোমেটিক ওয়াইপারে শার্লট ব্রিজউড একধরনের রোলার ব্যবহার করেন যার মাধ্যমে উইন্ডশিল্ডের উপর চলতে পারতো। একই বছর তিনি অটোমেটিক ওয়াইপারের পেটেন্ট লাভ করেন।
বৃষ্টির সময়ে গাড়িতে যে ওয়াইপার ব্যবহার করা হয়, তার অটোমেটিক এবং ম্যানুয়াল দুটোরই উদ্ভাবক মেরী এন্ডারসন
সিনেমাপ্রেমীরা ফ্লোরেন্স লরেন্স এর নাম নিশ্চয় শুনে থাকবেন, তাকে বিশ্বের প্রথম মুভি স্টার বলা হয়। এই ফ্লোরেন্স লরেন্স উদ্ভাবন করেছিলেন দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি যার ব্যবহার ছাড়া আজকাল গাড়ির কথা ভাবাই যায়না আর না ভাবাটা সম্পূর্ণ বোকামি। তার প্রথম উদ্ভাবন ছিলো ‘অটো সিগনালিং আর্ম’ যা বর্তমানের সিগনাল বা ইন্ডিকেটর লাইটের আগের সংস্করণ। ফ্লোরেন্স লরেন্স অটো সিগনালিং আর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন দুইটি পতাকা যা লাগানো থাকতো গাড়ির পেছনে এবং একটি স্বয়ংক্রিয় বোতামে চাপ দিলে সেই পতাকাগুলো নড়তে শুরু করতো।
চলচ্চিত্র তারকা ফ্লোরেন্স লরেন্স ‘অটো সিগনালিং আর্ম’ ও ‘স্টপ ব্রেক’ এর উদ্ভাবক ছিলেন
ফ্লোরেন্স লরেন্সের অন্য উদ্ভাবনটি হলো স্টপ ব্রেক। আমরা এখন গাড়িতে ব্রেক চাপলে গাড়ির পিছনে যেরকম ব্রেক লাইট জ্বলে ওঠে, তেমনই সেই সময়ে ফ্লোরেন্সের আবিষ্কৃত প্রযুক্তিতে গাড়িতে ব্রেক চাপলেই পেছন দিকে এক ধরনের ওয়ার্নিং সাইন জ্বলে উঠতো। তিনি এই দুটো উদ্ভাবনের পেটেন্ট করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি উদ্ভাবনদ্বয়ের জন্য কোনো সম্মান বা ক্রেডিট পাননি।
এরপর আসা যাক ডরোথি পুলিঞ্জারের কথায়। তিনি শুধু বিশ্বের প্রথম মহিলা গাড়ি ডিজাইনারদের একজন ছিলেন না, বরং তিনি বিশ্বের প্রথম কার ডিজাইনার যিনি গাড়ি ডিজাইন করেছিলেন মেয়েদের চাহিদা এবং প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে। ডরোথির বাবা ছিলেন স্কটল্যান্ডের তৎকালীন গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এরল জনস্টনের ম্যানেজার। সেই সুবাদেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে ডরোথি ঢোকেন এরল জনস্টনে। এছাড়া সেই সময়ে তিনি ইন্সটিটিউশন অফ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার্সে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মেয়ে বলে সেই সময়ে তাকে যোগদান করতে দেওয়া হয় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তার বাবা তাকে এরল জনস্টনের সাবসিডারি কোম্পানি গ্যালোওয়ে মোটর্স এর ইনচার্জ হিসেবে ঢুকিয়ে দেন। ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ডরোথি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়েদের গুরুত্ব দেন এবং তার হাত ধরেই গ্যালোওয়েতে অনেক নারী কর্মী নিযুক্ত হন। ডরোথি অন্যান্য নারী কর্মীদের নিয়ে ফিয়াট ৫০১ গাড়ির আদলে তৈরি করেন গ্যালোওয়ে ১০/২০। পরবর্তীতে ডরোথি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ৯২ বছর বয়সে মারা যান।
ডরোথি পুলিঞ্জার বিশ্বের প্রথম কার ডিজাইনার, যিনি গাড়ি ডিজাইন করেছিলেন মেয়েদের চাহিদা ও প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে
এরকম আরেকজন কার ডিজাইনার হলেন- হেলেন রোথার, যিনি ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্স থেকে তার ৭ বছরের মেয়ে নিয়ে পালিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে কিছুদিন বিখ্যাত মারভেল কমিক্স এর চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি যোগ দেন জেনারেল মোটর্সে। হেলেন রেথার ছিলেন জেনারেল মোটর্স এর প্রথম নারী কার ডিজাইনার। জেনারেল মোটর্সে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি নিজেই একটি কার ডিজাইন ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
হেলেন রেথার ছিলেন জেনারেল মোটর্স এর প্রথম নারী কার ডিজাইনার
এবার চলে আসি আধুনিক যুগে। ২০১৪ সালে জেনারেল মোটর্সের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড্যান একারসন পদত্যাগ করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন মেরী বারা এবং ইতিহাস সৃষ্টি করেন। বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তিনিই প্রথম নারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ১৯৮০ সালে জেনারেল মোটর্সে যোগ দেওয়া মেরী পেশায় একজন ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। জেনারেল মোটর্স এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে তিনি জেনারেল মোটর্সের গ্লোবাল প্রোডাক্ট ডেভলপমেন্ট বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। ২০১৫ সালে তিনি টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী মানুষের একজন হওয়ার সম্মান লাভ করেন।
আধুনিক যুগে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখা আরেকজন নারীর নাম মিশেল ক্রিস্টেনসেন। আধুনিক যুগের গাড়ির ডিজাইনে মিশেলের অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করা যায়না। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান হোসে তে জন্ম নেওয়া মিশেল কার ডিজাইনের উপর পড়াশোনা করেছেন। তিনি হোন্ডা এনএসএক্স (যুক্তরাষ্ট্রে একুরা এনএসক্স) গাড়ির ডিজাইন করেন, যা ২০১২ সালে ডেট্রয়েট অটো শোতে উদ্বোধন হয়। বর্তমানে তিনি বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হোন্ডার প্রিন্সিপাল ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি মিশেল কে হোন্ডার একটি সুপারকার ডিজাইন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্য অনুযায়ী মিশেল বিশ্বের প্রথম নারী সুপারকার ডিজাইনার। মিশেলের ডিজাইন করা গাড়িগুলোর মধ্যে হোন্ডা এনএসএক্স, একুরা আরএল, একুরা জেডডিএক্স অন্যতম।
বিশ্বের প্রথম নারী সুপারকার ডিজাইনার মিশেল ক্রিস্টেনসেন
ম্যারি এন্ডারসন, বার্থা বেঞ্জসহ অন্যান্যরা যারা মোটরগাড়ি শিল্পে অবদান রেখেছেন, তাদেরকে নারী দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। বার্থা বেঞ্জ, ম্যারি এন্ডারসন প্রমুখের হাত ধরে মোটরগাড়ি শিল্পে নারীরা তাদের দক্ষতা দেখিয়েছে এবং কাজ করছে। আশা করি, এর ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও বজায় রাখবে নারীরা।
লেখক- মেহরাব মাসাঈদ হাবিব
ফাউন্ডার ও ট্রেইনার, বাংলা অটোমোবাইল স্কুল, ‘অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং আদি অন্ত’ গ্রন্থের লেখক